পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে “ময়ূরখীল দাতব্য চিকিৎসালয়”
ছবি বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি জনপদগুলো দীর্ঘদিন ধরেই মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ভৌগলিক দূরত্ব, কঠিন যোগাযোগব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী জনবলের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে এখানকার মানুষ বিশেষত নারী ও শিশুরা নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হয়। প্রজনন স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন সেবা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতার অভাব এখানকার জনগোষ্ঠীকে আরও দুর্বল করে তোলে। রোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে অনেকসময় পায়ে হেঁটে বা প্রচণ্ড দুর্গম পথ অতিক্রম করে যেতে হয়, যা জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই বাস্তবতায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রিত যাকাত ওয়েলফেয়ার ফান্ড এর উদ্যোগ। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার লক্ষীছড়ি ইউনিয়নের দূরবর্তী ময়ূরখীল এলাকায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় “ময়ূরখীল দাতব্য চিকিৎসালয়”।
এই চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হলো—দুর্গম পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় মানসম্মত, নিরাপদ ও মানবিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের কার্যক্রম
চিকিৎসালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিতভাবে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিম্নোক্ত সেবাগুলো প্রদান করা হচ্ছে—
১. বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ
সাধারণ রোগব্যাধি, শিশুদের সাধারণ অসুস্থতা, মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা ইত্যাদির জন্য নিয়মিত চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
২. চোখের ছানি অপারেশন
চোখের ছানি রোগে আক্রান্ত দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিহ্নিতকরণ, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং অপারেশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
৩. সুন্নতে খতনা
স্থানীয় শিশুদের জন্য নিয়মিতভাবে বিনামূল্যে সুন্নতে খতনা সেবা প্রদান করা হয়—যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর বড় সহায়তা।
৪. মাতৃত্ব ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সচেতনতা
গর্ভধারণকালীন করণীয়, প্রসব-পরবর্তী যত্ন, নবজাতকের পরিচর্যা, মায়ের পুষ্টি ও মানসিক সুস্থতা বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার আয়োজন করা হয়।
এছাড়া নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও অজ্ঞতা দূরীকরণেও কার্যকর সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
৫. পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি শিক্ষা
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টি ঘাটতি বেশি থাকার কারণে পুষ্টিজনিত সমস্যা প্রতিরোধে বিশেষ সচেতনতা সেশন পরিচালনা করা হয়।
সেবার ব্যাপ্তি ও অর্জন
চিকিৎসালয়টি কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার পরিবার এই সেবার আওতায় এসেছে—যা পার্বত্য অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন।
ধারাবাহিক চিকিৎসা, বিনামূল্যে ওষুধ এবং নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে ইতোমধ্যে বাস্তব পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
যাকাত ওয়েলফেয়ার ফান্ড ভবিষ্যতে ময়ূরখীল দাতব্য চিকিৎসালয়ের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশেষত—
- আরও উন্নত স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা সংযোজন
- বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়মিত ভিজিট
- মাতৃত্বকালীন সেবার উন্নয়ন
- শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা আরও বিস্তৃত করা
- পাহাড়ি এলাকাজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক তৈরি
ইনশাআল্লাহ্, নিকট ভবিষ্যতে এই চিকিৎসালয় পুরো অঞ্চলের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও মানবিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
উপসংহার
ময়ূরখীল দাতব্য চিকিৎসালয় শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নয়—এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে আশার প্রতীক। শিক্ষা, সচেতনতা এবং সহজলভ্য চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও মানবিক পদক্ষেপ। যাকাত ওয়েলফেয়ার ফান্ডের এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা পার্বত্যাঞ্চলের স্বাস্থ্যখাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

